চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা…


জয়দীপ

(এ লেখায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছি সংস্কৃত সাহিত্যে নানা চুরির ঘটনার মধ্যে। চৌর্যবৃত্তির তখন স্বর্ণযুগ......)

কথায় আছে চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা। এই চুরিবিদ্যা দশমহাবিদ্যার অন্তর্গত অন্যতম এক বৃত্তি। বিষয়নিস্পৃহ পাঠক যদি প্রশ্ন তোলেন কি হবে চুরির গল্প অথবা চুরির কৌশল জেনে? চৌর্যকর্ম  বিহিত-কর্ম তো নয়ই, বরং নিষিদ্ধ-কর্ম, তবে তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি এই প্রশ্নের সম্মুখীন সব চৌর্য-শাস্ত্রকে হতে হয়েছে এবং এই প্রশ্নের উত্তর তারা দিয়েছেন এইভাবে যেচোর-শাস্ত্র জানলে মানুষের বুদ্ধি বাড়ে, মানুষ চতুর হয়। চোরচক্রবর্তী গ্রন্থে বলা হয়েছে,

চোরচক্রবর্তী কথা শুনিতে মধুর
যে কথা শুনিলে লোক হয় তো চতুর।

চুরি বা চৌর্যবৃত্তি সম্পর্কে যখন লিখতে বসেছি, শব্দটার উৎপত্তি নিয়ে দু-এক কথা জেনে নিলে আশা করি অন্যায় হবে না। আমাদের ভাষা মূলত তৈরি হয়েছিল ইন্দো-ইউরোপীয়। এই ভাষা সৃষ্টির সময় থেকে প্রায় দু-হাজার বছর ধরে এই ভাষাগোষ্ঠীর সমাজে ক্রাইম বলতে ছিল শুধু চুরি। এর উদাহরণ মিলেছে বৈদিক তায়ুশব্দ মানে চোর এবং সংশ্লিষ্ট তিনটি শব্দে- স্তেন (মানে চোর, চুরি), স্তেয় (মানে চুরি) এবং অস্তেয় (চুরি না করা)। তায়ু শব্দটি অবশ্য প্রাচীন ইরানীয় জেন্দ-আবেস্তায় ও পাওয়া যায়। এমনকি ইংরেজি thief শব্দটি ও তায়ু শব্দের সংশ্লিষ্ট বলে অনেকে মনে করেন। চুরি ডাকাতি যে শুধু আজকেই আছে তা নয়, গ্বেদে মিলছে চোরেদের কথা , বাইবেলেও রয়েছে তাদের সপ্রসঙ্গ উল্লেখ। যে সময় ঋগ্বেদ রচিত হয়েছিল তখন প্রধান ক্রাইম ছিল চুরি। তখনকার সমাজে প্রধান সম্পত্তি ছিল গরু। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১০৮ সূক্তে রয়েছে এরকম এক গল্প- বিদেশী একদল ডাকাত বা বেনে, যাদের নাম ‘পণি’, তারা লুকিয়ে এসে দেবতাদের গরু চুরি করে চম্পট দেয়। দেবতারা তাদের হারানো গরুর খোঁজ পেতে নিয়োগ করেছিল কুক্কুরী সরমাকে। এই সরমা থেকেই পরবর্তী কালে সারমেয়শব্দটার উৎপত্তি। যা হোক সরমার দেওয়া খবরের সুবাদে দেবতারা তাদের হৃত সম্পদ পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। লক্ষণীয় ব্যাপারটা হল গোয়েন্দা গল্পে কুকুরের নিয়োগ- সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে হয়তো এই প্রথম। এই যে গরু চুরির কথা বললাম এর নিদর্শন পাচ্ছি মহাভারতেও- মহানন্দে ইন্দ্রপ্রস্থে সময় অতিবাহিত করছেন পাণ্ডবেরা। এমন সময় এক বৃদ্ধ ব্রাক্ষ্মণ অর্জুনের কাছে এসে অভিযোগ জানালেন দস্যুরা তার গরু চুরি করে পালিয়েছে। এর পরের ঘটনা তো সবারই জানা। সে সময় দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী হিসেবে দিন কাটাচ্ছিলেন। সে সময় যুধিষ্ঠিরের ঘরে যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদীর নিভৃত আলাপচারিতার মাঝে অর্জুনের অনধিকার প্রবেশ এবং ফলস্বরূপ বারো বছরের বনবাস। জাতক-মালা বা অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যেও উল্লেখ রয়েছে চৌর্যবৃত্তির। বেদের কাল থেকে আজ ইস্তক চলে আসা এই পেশার মানুষকে ভয়ে ও শ্রদ্ধায় কত নামই দিয়েছে তা বলা মুশকিল, তার মধ্যে কিছু শ্রুতিমধুরও, যেমন নিশি-কুটুম্ব বা স্কন্দোপজীবী।

তখনকার দিনে কড়া শাসন ধরা পড়লে চোরকে চড়ানো হত শূলে অথবা কেটে নেওয়া হত হাত বা মাথা। এইরকম অবিচারের বিরুদ্ধে আইনের ব্যাখ্যাকার মনু সতর্ক করে দিয়েছেন: ন্যায়বান রাজা মাল-সমেত চোরকে ধরতে না পারলে সেই চোরের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। চোরাই মাল ও সরঞ্জাম সহ হাতে নাতে ধরা পড়লে তবেই পাওয়া যাবে চরম সাজা। এইসব কড়াকড়ির ফলে চোরের মর্যাদা তো কমেই নি বরং বেড়েছে চোরের ইজ্জত। সময় সময় সে যে পুলিশের পদেও উন্নীত হয়েছে তার ইঙ্গিত পাই চর্যাপদের গানে-

যো সো চৌর সোই দুষাধী
যে সে চোর যেই চোর-ধরা

দুষাধীমানে যে দুঃসাধ্য কর্ম করে অর্থাৎ দক্ষ ব্যক্তি, গোয়েন্দা। দিনে দিনে গড়ে উঠেছে চৌর সংঘ। আগমন ঘটেছে ধুতালিয়া (প্রবঞ্চক, ঠক), সিন্ধালিয়া (সিঁধেল চোর), বুড়োলিয়া (ডুবুরি চোর), গলসী (ফাঁসুড়ে), বাটপাড়, ডাকা-চুরি (ডাকাত), লুকা-চুরি (আধুনিক অর্থে গোপনে চুরি) এসব পেশার মানুষদের। বিপুল এই মহাবিদ্যার শাস্ত্র- চৌর্যচর্যা, ষন্মুখকল্প ইত্যাদি। চৌর ধর্মের দেবতা হলেন দেবসেনাপতি স্কন্দ বা কার্তিকেয়। কেন? এর মূলে রয়েছে পুরাণেরই এক গল্প। তারকাসুরকে বধ করবার উদ্দেশ্যে কার্তিক সে সময় তাড়া করেছেন তারকাসুরকে। তারকাসুর গিয়ে আশ্রয় নিলেন ক্রৌঞ্চ-মিথুন পর্বতের এক গুপ্ত গুহায়। সে সময় কার্তিক পাহাড়ের ভিতর দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে (আধুনিক পরিভাষায় সিঁধ কেটে আর কি!) তারকাসুরকে খুঁজে বার করে হত্যা করেন। সুতরাং কার্তিক যে পুরাণের এক বিখ্যাত সিঁধেল তাতে আর সন্দেহ কি। প্রাচীন শাস্ত্রমতে চোর-ধর্মের প্রবর্তক তিনিই। বাঙালি চোরেদের কাছে অবশ্য মা কালীর গুরুত্ব অনেক বেশি-

নিশিকালী মহাকালী উন্মত্তকালী নাম ।
চরণে পড়লু মাতা আইস এই ধাম।

চৌর-শাস্ত্রের সকলের বড় ঋষি বোধ হয় ভগবন কনকশক্তি। আর এক জাঁদরেল শাস্ত্রকার মূলদেব। তিনি নিজেও মহা-গুণী তস্কর- শুধু শাস্ত্রবচন নয়, কায়দাগুলোকে হাতে কলমে প্রয়োগ করার শক্তি রাখেন। এ শাস্ত্রের ভাষ্যকার ভাস্করনন্দী। চৌষট্টি কলার এক কলারূপে বন্দিত এই বিদ্যা। চোরচক্রবর্তী পুঁথির বিখ্যাত চোর খরবর (মতান্তরে হয়বর ) যার মহা-সম্ভ্রান্ত পিতা উগ্রসেন বিজয়নগরের রাজসভার পাত্র, দেখা যাচ্ছে সকল শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়েও কায়-মনে চৌর-শাস্ত্র অধ্যয়ন করছেন। দশকুমারচরিতে রয়েছে সর্বশাস্ত্র শিখেও রাজকুমারের বিদ্যা অসমাপ্ত থেকে গেল যতক্ষণ না চৌর-শাস্ত্র সম্যক রূপে অধিগত হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে চোর কি সবাই হতে পারে? যদি ক্লিপ্টোম্যানিয়াক না হয়ে থাকেন তবে শুনে রাখুন ভাল চোর হতে গেলে যে বিস্তর গুণাগুণের অধিকারী হওয়া আবশ্যক তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে মৃচ্ছকটিক নাটকে। সেখানে কীর্তিমান চোর স্বগতোক্তি করেছে:
আমি বিড়ালের ন্যায় নিঃশব্দে গমন করতে পারি। মৃগের ন্যায় দ্রুতবেগে দৌড়াইতে পারি। শ্যেন পক্ষীর ন্যায় সহসা গ্রাহ্য বস্তু ধরিতে ও খণ্ড খণ্ড করিতে পারি। কুক্কুরের ন্যায় নিদ্রিত ও জাগরিত ব্যক্তির বল পরীক্ষা করিতে পারি। সর্পের ন্যায় বক্ষোপরিও গমন করিতে পারি। এবং আমি নানাবিধ রূপ ধারণে ও বিবিধ বেশ বিন্যাসে ঐন্দ্রজালিকের সদৃশ, সর্বদেশীয় ভাষার উচ্চারণে দক্ষ, এবং স্থলপথে ঘোটকের ও জলপথে নৌকার তুল্য।
আচ্ছা চোরের জাত কি? মানে চোর মাত্রেই কি শূদ্র, কিছু অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ? শাস্ত্রে বলেছে চোরের কোন জাত নেই, চোর যে কেউই হতে পারে, অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, এমনকি ব্রাক্ষ্মণ হয়েও চোর হতে পারে। মৃচ্ছকটিক নাটকের শর্বিলক ব্রাক্ষ্মণ হয়েও চৌর্য-বিদ্যায় পারঙ্গম। দশকুমারচরিতের রাজপুত্র অপহারবর্মণ যেমন শাস্ত্রজ্ঞ, চৌরকলার অনুশীলনেও তেমনি ওস্তাদ। ধন- ঐশ্বর্য নিতান্ত নশ্বর, ধনের অহংকার অবিধেয় এই সত্য প্রমাণ করার জন্য অপহারবর্মণ ধনীর টাকা চুরি করে ভিক্ষুকদের বিতরণ করতেন।  বিখ্যাত চোর খরবর-এর কথা তো আগেই বলেছি। তিনি কাব্য শিখেছেন, জ্যোতিষ শিখেছেন। তিনি চণ্ডীর উপাসক, মায়াজাল-তন্ত্রে সুপণ্ডিত, পরম বিচক্ষণ তীক্ষ্ণবুদ্ধি, ভেল্কি-বিশারদ। এহেন খরবর শেষে উত্তম-অধম চৌর-বিদ্যা শিখে ফেললেন। অদ্বিতীয় হলেন। দেশের চোর সমাজ তাকে সসম্ভ্রমে চোর-চক্রবর্তী রূপে মেনে নিলো। একবার এক কবি চোর সিঁধ কেটে ঢুকে পড়েছে রাজা ভোজের ঘরে। ভোজরাজ মস্ত কবি। জানালায় বসে আকাশের চাঁদ নিয়ে কবিতা রচনা করছেন। রাজাকে দেখে চোর অন্ধকারে লুকিয়ে পড়লো। রাজা এক ছত্র লেখেন আর নিজেই আবৃত্তি করে ওঠেন। শেষে এক ছত্রে গিয়ে রাজা পড়লেন ফাঁপরে। কিছুতেই মিল খুঁজে পান না। এদিকে চোরও স্বভাবে কবি। আত্মবিস্মৃত হয়ে পরের ছত্র সে আবৃত্তি করে ওঠে ছন্দ-অর্থ মিলিয়ে। ব্যস-শুরু হয়ে গেল রাজবাড়িতে হৈ চৈ। রাজবাড়িতে চোর পড়েছে। অতঃপর চোর গ্রেপ্তার। পরদিন বিচারের জন্য চোরকে আনা হল রাজসভায়। তখন শাস্তি ছিল শূলে চড়ানো অথবা হাত কেটে ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু রাজা অন্য চরিত্রের। গুণীর কদর করতে জানেন তিনি। তাই শাস্তির বদলে রাজা চোরকে দিলেন দশ কোটি স্বর্ণমুদ্রা-রাজার পাদপূরণের পারিতোষিক। আর দিলেন কবি সম্মান। রৌহিনেয় জাঁক করেছে- তার বাপ ঘুঘু চোর, মাও তাই। চৌর-সমাজে সে তাই নৈকষ্যকুলীন। কৃতী পিতা মরণাপন্ন, এমন সময়ে বিধবা মা রৌহিনেয়ের উপর কুল ধর্মের ভার দিয়েছেন কপালে সপ্ত-শিখার প্রদীপ ঠেকিয়ে। ঠিক যেমনটি হয় রাজার মৃত্যুর পর রাজপুত্রের অভিষেকের সময়ে। রাজগণের মধ্যে যেমন সবচেয়ে বড় রাজচক্রবর্তী, তেমনি চোরেদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ পদাধিকারী হলেন চোরচক্রবর্তী। রাজার ধর্ম যেমন দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন তেমনি চোরচক্রবর্তীর ধর্ম চোরের পালন, গৃহস্থের শাসন। পুরানো পুঁথিতে পুঁথিতে বর্ণিত চোরেদের সেসব বিচিত্র কাহিনী। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক: চোরেরা হাহাকার করে এসে মাথা নুইয়েছে খরবরের কাছে। রাজার অত্যাচারে তাদের চুরি করা লাটে উঠেছে। একথা শুনে চম্পাবতীর রাজাকে উচিত শাস্তি দেবার জন্য চোর-চক্রবর্তী প্রতিজ্ঞা নিলেন:

চম্পাবতী পুরীখান করিমু বিকল।
তবে চোর-চক্রবর্তী নাম হইবে সফল।।
নগরিয়া লোক সব করিমু ভিখারি।
কেমতে রাখিবে রাজা আপনার পুরী।।

এবার আসা যাক চুরি করার প্রণালীর কথায়। পাঠক যদি ভেবে থাকেন এ প্রণালীর যৌক্তিকতা কোথায়, তবে বলে রাখি গুরুর কাছে তালিম নেওয়া থেকে শুরু করে পূর্ণমাত্রায় চৌর-বিদ্যায় পারঙ্গম হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য প্রয়োজন অসীম মনঃসংযোগ এবং পরিশ্রম। দেহ আর মনের পর স্থাপন করতে হয় সম্পূর্ণ আধিপত্য। আয়ত্ত করতে হয় বিভিন্ন পশুপাখির ডাক-চৌরকর্মে প্রয়োজন হতে পারে যে কোন সময়। শিয়ালের ডাক শিখতে হয় সবার আগে।  যেহেতু চোরের কাজ মূলত অন্ধকারে, তাই চোখ ও কাল দুটো ইন্দ্রিয়কেই হতে হয় অত্যন্ত প্রখর। দুই ইন্দ্রিয় প্রাখর্যই নয়, ইন্দ্রিয়সংযমও অসীম প্রয়োজন চৌর-বিদ্যায় পারদর্শী হতে গেলে। সন্ন্যাসী হতে গেলে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু চোর হতে গেলে কাঞ্চন-মোহ থাকলেও কামিনীর মোহ নৈব নৈব চ। তাই চোর অর্ধ-সন্ন্যাসী। চুরি করতে গেলে প্রথমেই দরকার চুরির যোগ্য জিনিষের খোঁজ, যে বাড়িতে আছে তার নকশা, বাড়ির বাসিন্দাদের গতিবিধি। এসব খোঁজ দেওয়ার জন্য থাকে খোঁজদার বা খুঁজিয়াল। অনেক সময় খুঁজিয়াল চলে চোরের সাথে। হাতে মশাল-নারকেল-তেলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে কাঠির মাথায় জড়ানো। এই বস্তুও সরঞ্জামের মধ্যে পড়ে। হঠাৎ করে গেরস্থ জেগে উঠে ঝামেলা শুরু করলে খড়ের চালের উপর জ্বলন্ত মশাল ছুঁড়ে দিয়ে পালাও ছুটে। এক বাড়িতে ভিন্ন ভিন্ন চোর এসে হাজির হলে চোরে চোরে চেনা-জানার জন্য রয়েছে নানারকমের গুপ্ত সংকেত-যার পোশাকি নাম চৌর-সংজ্ঞা। ভুল করে এক চোর যেন অন্য চোরের ক্ষতি না করে বসে। কিন্তু বাইরের চতুর লোকে অনেক সময় চৌর-সংজ্ঞা জেনে গিয়ে ঠিক উল্টোটাই ঘটিয়েছে অনেক সময়। রাজপুত্র বরসেন চার চোর দেখতে পেয়ে চৌর-সংজ্ঞা করলেন। সম্পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করলেন তারপর তিনিই তাদের চোরাই মালের উপর বাটপাড়ি করলেন।

এরপর সিঁদকাঠি নিয়ে চোরেরা হাজির হয় অকুস্থলে। প্রাচীনকালে বেদের যুগে অবশ্য ছিল তালোঘাটিনী মন্ত্র এই মন্ত্র পড়ার সাথে সাথে তালা খুলে পড়বে। প্রাচীন শাস্ত্রে রয়েছে এক রকমের পাতার কথা, পাতা ছুঁয়ে চোর দরজা খুলতো। সমরাদিত্য-সংক্ষেপ নামে পুঁথিতে রয়েছে এক গল্প:

গুরু শিষ্যকে তালা ভাঙার মন্ত্র দিচ্ছেন, কিন্তু চুক্তি হচ্ছে শিষ্য কখনো মিথ্যা বলতে পারবে না। আর গুরুর কথা অবাধ্য হলে তালা ভেঙে ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই গৃহস্থ ধরবে ক্যাঁক করে-সুতরাং চরম নিষ্ঠাবান হতে হবে চোরকে। শাস্ত্রে রয়েছে কৃষ্ণাক্ষর নামক এক রকমের মায়া-মন্ত্রের কথাযা পাঠ মাত্র-ই দরজা আপনি হাঁ হয়ে যাবে, আঙ্গুল ঠেকাবারও প্রয়োজন হবে না। রৌহিনেয়ের উপাখ্যানে রয়েছে চৌরমন্ত্রের কথা- এই মন্ত্র দিয়ে যারা চোর ধরতে বেরিয়েছে তাদের মধ্যেই ঝামেলা বাধিয়ে দেওয়া যায়। রয়েছে আরও কত মন্তরনিদালি মন্তর, চাবি খোলার মন্তর, কুকুরের মাড়ি আঁটা মন্তর ইত্যাদি। তবে শুধু মন্তরে কিছু হয় না, উচ্চারণের কায়দা থাকা চাই-আর সেসব শেখানোর জন্য চাই উপযুক্ত গুরুর খোঁজ। রয়েছে মায়া-অঞ্জনের কথা। এই কাজল চোখে দিয়ে চোর অদৃশ্য হয়ে যায়। সকলের চোখে সে অদৃশ্য, কিন্তু তার চোখে সবাই দৃশ্যমান। নেওয়ারি ভাষায় লেখা হাজার বছরের এক পুরনো পুঁথি, নাম ষন্মুখকল্প এতে রয়েছে মায়া-অঞ্জনের মন্ত্র: ওঁ চন্দ্রমৃচ্যময়নৃষ্টি দেবনির্মিতং হর হর সময় পূরয়: হুং স্বাহা”। রয়েছে মায়া-অঞ্জন তৈরির পদ্ধতি ও। তৈরির উপকরণ: উলুক অর্থাৎ পেঁচার বাসা, সিদ্ধার্থ অর্থাৎ আতপ চাল এবং কপিলা-ঘৃত। সমস্ত একসাথে করে জ্বালিয়ে বানাতে হবে তেল। তারপর পদ্মসূত্রের সলতেয় করে কপালে ঐ তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে লাগাতে হবে চোখে কাজল। ও হ্যাঁ, এর সাথে আগের মন্তর টা জপতে হবে একশ বার। ব্যস, চোখের জোরে সকলকে বশে এনে ইচ্ছাসুখে সে হরণ করতে পারে। এক চোরকে নিয়ে আবার কি কাণ্ড! মায়া-অঞ্জন পরে ঢুকেছে চুরি করতে। বাড়ির লোক বুঝতে পেরেছে চোর ঢোকার কথা। কিন্তু কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। একজন বুদ্ধি করে তখন দুঃখের গল্প ফাঁদল- চোরের মায়ের মৃত্যু-কথা। মায়ের কথা শুনে চোরের শোক উথলে ওঠে। দরদর করে চোখ দিয়ে পড়তে থাকে জল। চোখের জলে অঞ্জন ধুয়ে গেল। এইবার-পালাবি কোথায় চাঁদ- ক্যাঁক করে গেরস্ত এসে ধরলো চোরকে। এ যুগে এসবের সাহায্য না থাকলেও চোর সিঁদকাঠি নিয়ে হাজির হয় অকুস্থলে, সিঁদ (সংস্কৃত ভাষায় সন্ধি) কাটা আবার যেমন তেমন ব্যাপার নয়, রীতিমত শিল্পকর্ম। খন্তায় করে ধীরে ধীরে শুরু করতে হবে মাটি কাটা-অত্যন্ত নরম হাতের কাজ। সঙ্গী লোক দু-হাতে অঞ্জলি পেতে সিঁধের নিচে ধরে থাকবে। মাটি যা পড়বে সব হাতের উপর। সঙ্গে হাড়ি থাকলে ভাল। হাত ভর্তি মাটি হাড়িতে করে ফেলে আসতে হবে দূরে। সিঁধ কেটে দেয়াল একেবারেই ফাঁক করতে নেই, কিছু বাকি রেখে দিতে হয়। মুরুব্বিদের অভিমত হল মেটে দেওয়াল হলে চার-পাঁচ ইঞ্চির মতো, ইটের গাঁথনি হলে একখানা ইট বাকি রেখে দেবে। বলে রাখা ভা সিঁদ বস্তুটা আজকের নয়। হাজার দুয়েক বছর আগেও উৎকৃষ্ট সিঁধের খবর মিলছে। এই সিঁধ সাত প্রকার :

পদ্মব্যাকোশং ভাস্করং বালচন্দ্রং/ বাপী বিস্তীর্ণং স্বস্তিকং পূর্ণকুম্ভম

পদ্মব্যাকোষ অর্থাৎ ফুটন্ত পদ্মফুলের মতো সিঁধ, ভাস্কর অর্থাৎ সূর্যের মতো গোলাকার, বালচন্দ্র অর্থাৎ কাস্তের আকারের চাঁদের মতো, বাপী অর্থাৎ পুকুরের মতো চৌকোণা, বিস্তীর্ণ অর্থাৎ অনেকখানি চওড়া। এছাড়া রয়েছে স্বস্তিকের চেহারার সিঁধ আর পূর্ণকুম্ভের চেহারার সিঁধ। মোট এই সাত। মুরুব্বিদের অভিমত হলো সিঁদ কেটে দেয়াল একেবারে ফাঁক করতে নেই, কিছুটা বাকি রেখে দিতে হয়। মেটে দেয়াল হলে চার-পাঁচ ইঞ্চির মতো, ইটের গাঁথনি হলে একখানা ইট।

জায়গা বিশেষে অবশ্য সিঁদ কাটার পদ্ধতি আলাদা আলাদা। কার্তিক ঠাকুর অবশ্য চার প্রকার লক্ষণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। শর্বিলক স্বগতোক্তি করেছে:

ভিত্তি পক্ক ইষ্টকের হইলে আকর্ষণ, অপক্ক হইলে ছেদন, ও কেবল মৃত্তিকার হইলে জল সেচন করিতে হয়, এবং কাষ্ঠের হইলে কাটিতে হয়।

যেন-তেন প্রকারেণ সিঁদ কাটলে চলবে না, এ একপ্রকার শিল্পকর্মই বটে! দেহের মাপজোক সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা চাই, যাতে সিদের মধ্যে দিয়ে নিজের পুরো শরীর গলিয়ে দেওয়া যায়। সিঁধকাটি ছাড়াও সঙ্গে রাখতে হবে সুতো। সুতোর অনেক কাজ। হয়তো দরজায় খিল দেওয়া আছে- সুতোর মাথায় বড়শি গেঁথে দাও নামিয়ে। তারপর বড়শি দরজার খিলে আটকে গেলে সন্তর্পণে সুতোতে দাও টান। এছাড়াও আছে। রাত্রিবেলা অন্ধকারের মধ্যে বসে কাজ- হয়তো সাপে দিলো কামড়ে। ঐ সুতোয় তাগা বেধে তখন যাওয়া যাবে ওঝার বাড়ি। ব্রাক্ষ্মণ হলে অবশ্য একটা সুবিধা আছে। সুতো নিয়ে যেতে ভুলে গেলেও গলায় আছে উপবীত। খুলে হাতে জড়িয়ে নিলেই হলো। শর্বিলকের ক্ষেত্রেই ঘটেছে এই ঘটনা:

হায়! কি কষ্ট! পরিমাণ সূত্রটি আনিতে বিস্মৃত হইয়াছি! এই যজ্ঞোপবীত টিই পরিমাণ সূত্র হইবে।

সুতরাং যারা নাস্তিক হয়ে উপবীত ত্যাগের পক্ষপাতী, তারা উপবীতের এই গুণাগুণ সম্পর্কে ভেবে দেখতে পারেন।  

সিঁদ কাটার কৌলীন্য প্রচার করার জন্য শর্বিলক মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বের অশ্বত্থামার সিঁদ কেটে পাণ্ডব-সন্তানদের হত্যার কথা উল্লেখ করেছেন। সিঁদ কেটে প্রথমে পাততে হয় কান। নিশ্বাসের শব্দ শুনে বুঝে নিতে হয় অন্দরের বাসিন্দাদের গতিবিধি। শর্বিলক ভেবেছেন: ইহারা ছল পূর্বক নিদ্রিত অথবা পরমার্থতঃ নিদ্রিত হইয়া রহিয়াছে, অগ্রে পরীক্ষা করিয়া দেখা যাউক। এরপর পরীক্ষা:

ইহারা যথার্থই নিদ্রিত হইয়াছে। যেহেতু ইহাদের নিশ্বাস বায়ু নাসারন্ধ্র হইতে নিঃশঙ্কে ও দীর্ঘাকারে বহির্গত হইতেছে। ইহারা মধ্যে মধ্যে স্বপ্ন দেখিতেছে। ইহাদের নেত্র সকল মুদ্রিত ও অভ্যন্তরে স্থিরীভূত হইয়া রহিয়াছে। এবং ইহাদের হস্তপদাদির সন্ধিস্থল শিথিল ও শরীর শয্যার সমান বিস্তৃত হইয়া রহিয়াছে। যদি ইহারা ছল পূর্বক নিদ্রিত হইত তাহা হইলে নেত্রে পতিত সম্মুখ-স্থিত দীপশিখার প্রভা কখনই সহ্য করিতে পারিত না।

Analysis টার কথা একবার সবাই ভেবে দেখবেন! এককথায় অসাধারণ। যদি মনে হয় কেউ হাল্কা জেগে আছে তার জন্য আছে ঘুমপাড়ানি মন্ত্র, যাকে চলতি ভাষায় বলে নিদালী মন্ত্র, বেদের কালে একে বলা হতো অবস্বপনিকা। এই মন্ত্রে হাল্কা ঘুম গভীর হয়, আর জেগে থাকা মানুষ ঘুমে অচেতন হয়ে যায়। মন্ত্র চলতি ভাষায় এমন শুনতে:

নিদ্রাউলি নিদ্রাউলি,
নাকের শোয়াসে তুললাম মঞ্চপের ধূলি
ঘরে ঘুমোয় কুকুর-বিড়ালি
জলে ঘুমায় বউ,
নিদালি-মন্তোরের গুণে
ঘুমাইয়া এক গিরস্তর বেটা-বউ।

রয়েছে হরেক রকমের গাছ-গুল্ম। ঘরে ঢুকে কিছু পাতা যে খাটে গৃহস্বামীর শুয়ে আছে তার খাটের তলায় রেখে আগুন ধরিয়ে দাও। আগুনটা নিভিয়ে দিলে ধোঁয়া বের হবে। ধোঁয়া নাকের ভিতর গেলে সমস্ত শরীর আচ্ছন্ন হয়ে আসবে। আরও আছে-সেই পাতার বিড়ি থাকবে চোরের মুখে। একদিকে চলবে নিপুণ হাতের কাজ, অন্যদিকে কান থাকবে মক্কেলের নিঃশ্বাস ওঠা-নামার উপর। উসখুস শুনলেই বিড়িতে টান দিয়ে পরিমাণ মতো ধোঁয়া ছাড়বে নাকে। ব্যস, কেল্লা ফতে!

সিঁদ কাটা আর ভিতরে ঢোকার আগে ভেতরে কেউ জেগে বসে আছে কিনা বোঝার জন্য রয়েছে নকল মানুষ প্রবেশ করানোর রীতি। একে বলা হয় প্রতিপুরুষ – “প্রতিপুরুষং নিবেশয়ামি”। ঘরে ঢুকে প্রথম কাজ দরজা খুলে ভেজিয়ে রাখা যাতে পালাতে কোনো অসুবিধা না হয় – “আত্মরক্ষার্থং দ্বারমুদ্ঘাটয়ামিআর পুরনো দরজা খুলতে গিয়ে যদি শব্দ হয়? তারও উপায় আছেদরজার জোড়গুলো জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া। ঘরে ঢুকে অন্ধকারে মালের হদিশ পাবার উপায়? মৃচ্ছকটিক নাটকে আছে মন্ত্রপূত বীজঘরে ঢুকে মেঝের উপর ছড়িয়ে দিতে হয়। মাল যেখানে আছে সেখানে বীজগুলো ফটফট করে ফুটে যাবে, অন্যত্র ফুটবে না। অর্বাচীন চোরেরা সাদা মটরদানা ছড়িয়ে দেয়। মটরদানা গড়িয়ে গিয়ে বিভিন্ন বিভিন্ন জিনিসে ধাক্কা খায় আর সেই বিভিন্ন প্রকার শব্দ শুনে চোরকে বুঝে নিতে হয় কোথায় কত দূরে কোন জিনিস আছে। “কথারত্নাকরএ আছে একরকমের শিকড়ের উল্লেখবাক্স পেঁটরায় শিকড় ঝুলিয়ে মালের হদিশ পাওয়া যায়। রয়েছে যোগবর্তিকা জ্বালানোর কথা, যা জ্বালিয়ে দিলে গৃহস্থের চোখে ধাঁধাঁ লাগবে, চোরকে দেখতে পাবে না। কিন্তু সেই আলোয় সব কিছু চোরের নজরে পড়বে।

সিঁদকাঠি দুই ধরণেরএকটা ত্রিকোণ ফলাযুক্ত, এতে মাটির দেওয়াল কাটা যায়। আর একটার মাথা চতুর্ভুজের মতো, এটি পাকা দেওয়াল কাটতে ব্যবহার করা হয়। কাপড়ের নিচে উরুর সাথে কাঠি বেঁধে নিতে হয়। লোকের নজর পড়ে না। হালকা জিনিস বলে হাঁটা, আর প্রয়োজন হলে দৌড়াতেও সমস্যা নেই। তবে সিঁদ কি সকলের ঘরে কাটা যায়? না, চৌর নীতি শাস্ত্রের নিষেধ:

ব্রাহ্মণ সজ্জন দাতা বৈষ্ণব তিনজন
ইহার ঘরে চুরি না করিও কখন

এছাড়াও আছে: রোগী থাকলে সে বাড়ি কখনো ঢুকবেন না। ভ্রষ্টা মেয়ের বাড়ি যাওয়া চলবে না। লম্পট ছেলেছোকরা থাকলে সেখানেও না- রাতের বেলা কোন ফিকিরে সুট করে বেরিয়ে পড়বে। প্রেমের দাপটে সবই সম্ভব কিনা! তবে চোর-চক্রবর্তীর পুঁথি ঘরে রাখলে চোরের ঢোকা মুশকিল-

এই পুঁথি যেই জন ঘরেতে রাখিবে।
তার ঘরে চোর চুরি করিতে নাড়িবে।।
 
অনেক কথা হলো চুরি নিয়ে। ধরা পড়ার কথাটা বলা হয় নি এখনো। ধরা পড়লে? তখনকার দিনে কড়া শাসনশূলে চড়ানো বা সন্দেহের বশে প্রাণ হনন। অবশ্য সন্দেহের বশে প্রাণ হননের বিরুদ্ধে আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে মনু সতর্ক করে দিয়েছেন চোরাই মাল ও সরঞ্জাম সবশুদ্ধ হাতে নাতে ধরলে তবেই চোর সাজা পাবে, নয়তো নয়। অবশ্য আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেও গ্রাম গঞ্জে চোর ধরা পড়লে সে সব মানা হতো না। পুলিশের বড়বাবু চোরকে তোলেন তুড়ুমএ। এ প্রসঙ্গে একজনের দারোগার জীবন কাহিনীর কথা মনে পড়ছে। তিনি গিরিশচন্দ্র বসু (১৮২৪(?)-১৮৯৮)। গিরিশচন্দ্র ছিলেন হিন্দু কলেজের একজন কৃতী ছাত্র। ১৮৫৩ সালে তিনি নবদ্বীপ থানার দারোগা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। প্রবীণ বয়সে নবজীবনমাসিকপত্রে তাঁর প্রথম জীবনের স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। নাম ছিল সেকালের দারোগার কাহিনী”। সেই বইতে চুরি-ডাকাতির নানা ঘটনা রয়েছে। মূলত: ডাকাতদের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে। তুড়ুমএর কথা বলছিলাম। এ বস্তুটি কি তা জানার জন্য গিরীশবাবুর শরণাপন্ন হওয়া যাক:

তুড়ুম জিনিসটা কি , তাহা বোধ হয় আমার পাঠকগণের মধ্যে অনেকে জানেন না। তুড়ুম শব্দ ফরাসী ভাষা, ইংরেজিতে ইহাকে stocks বলে। দুইখানা লম্বা ভারি কাষ্ঠ একদিকে শক্ত লোহার কব্জা দ্বারা আবদ্ধ, অন্যদিকে খোলা; কিন্তু ইচ্ছা করিলে শিকলের দ্বারা বন্ধ করা যায়। এই খোলা দিকের মাথা ধরিয়া উপরের কাষ্ঠকে উঠান নামান যাইতে পারে। প্রত্যেক কাষ্ঠেই কয়েকটি অর্ধচন্দ্রের ন্যায় এমন ভাবে ছিদ্র করা আছে যে একখানা কাষ্ঠের উপরে দ্বিতীয় খানা পাতিলে দুই ছিদ্রে একটা গোলাকার ছিদ্র হয়। আসামিকে বসাইয়া বা শুয়াইয়া তাহার দুই পা একখানি কাষ্ঠেরদুই ছিদ্রের ভিতরে রাখিয়া উপরের কাষ্ঠ দ্বারা তাহা চাপ দিলে পা সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ হয় এবং আসামি আর নড়িতে পারে না। বিশেষ কষ্ট দেওয়ার মানস থাকিলে, পার্শ্ববর্তী দুই ছিদ্রে পা না দিয়া, এক ছিদ্র মধ্যে রাখিয়া অন্তরের দুই ছিদ্রে পা আটকাইলে মানুষের অত্যন্ত ক্লেশ হয়।
এছাড়া কাঁটার বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়। ছাই-ভর্তি বস্তায় মুখ ঢুকিয়ে সেই বস্তা বেঁধে দেয়। নাক ও কানের ফুটোয় দেওয়া হয় লঙ্কার গুঁড়ো। রয়েছে আরও হরেক অভিনব পদ্ধতি। সবই মান্ধাতার আমলের চলে আসছে যুগ যুগ ধরে- সাঁড়াশি চিমটা কলকে মায় জ্বলন্ত কাঠই গায়ে চেপে ধরে। শীতের রাতে নগ্ন করে জল ছিটিয়ে মারতে থাকা হয় চাবুক। দুজনে পাখা করে যায় দু-দিক থেকে। ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মানুষটাকে- দুহাতের বুড়ো আঙুলে দড়ি বেঁধে আড়ার সাথে ঝোলায়, শুধুমাত্র পায়ের বুড়ো আঙুল মাটিতে ঠেকবে, অজ্ঞান হয়ে গেলে, নামিয়ে দস্তুরমতো জ্ঞান ভাঙিয়ে আবার ঝুলিয়ে দেওয়া হবে আড়ার সাথে। আরও একটা সাংঘাতিক শাস্তি আছে- নাভির উপর গুবরে পোকা ছেড়ে দেওয়া। বাটি চাপা দেওয়া আছে, পোকা যাতে বেরিয়ে না যায়। ফলটা আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন! গুবরে পোকা যাবার পথ খুঁজতে থাকে নাভির ভিতর দিয়ে। কি সাংঘাতিক!!

যদিও লেখার প্রথমে বলেছিলাম এই লেখায় নিজেকে সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা, তবুও গিরীশবাবুর লেখা থেকে আর একটা ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। ঘটনাটি পড়লে এটা অন্তত বোঝা যাবে সে সময়ের মানুষজন চোর-ডাকাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য কেমন ভাবে থাকত। গিরীশবাবুর আমলে নবদ্বীপ-শান্তিপুর অঞ্চলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবু ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষালের বেশ নামডাক ছিল। ঈশ্বরবাবুই গিরীশবাবুকে নবদ্বীপ থানার দারোগা পদে নিযুক্ত করেছিলেন। পেনশন নিয়ে চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর Government তাকে রায়বাহাদুর উপাধিতে সম্মানিত করেছিল। রানাঘাটের পালচৌধুরী বাবুদের দুটি বাসা বাড়ি ছিল। তার দক্ষিণদিকের বাড়িতে ঈশ্বরবাবু থাকতেন। একদিন রাতে ঈশ্বরবাবুর শোয়ার ঘর থেকে বেশ কিছু মূল্যবান জিনিস চুরি যায়। সেটা বড় কথা নয়। সে সময় এসব হামেশাই হত। এরপর গিরীশবাবুর জবানীতে:
এই স্থানে ঈশ্বরবাবুর শয়ন কক্ষের দৃশ্যটা বর্ণনা না করিলে পাঠক বুঝিতে পারিবেন না যে চোরে কি অসম সাহসী রূপে এই ঘরে চুরি করিয়া গিয়াছিল। ঘরের দুই কোণে দুইটি দুনলা বিলাতী বন্দুক; চারি প্রাচীরের গায় চারিখানা তরবার ও চারিটা ঢাল ঝুলিতেছিল। ঈশ্বরবাবু এক নেয়ারের অর্থাৎ ফিতার খাটে শয়ন করিতেন, শিয়রে একটা সেই সময়ের নূতন আবিষ্কৃত রিব্‌লবার পিস্তল ও দুইখানা ভুটিয়া ভোজালি, পদতলে একখানা বিলাতী হেঙ্গার তরবার। তদ্ভিন্ন ঘরের মধ্যে দুইটা মুদ্গর, একটা লেজাম ও কতকগুলি শূকর শিকারের বল্লমও ছিল। বন্দুক ও পিস্তল প্রত্যহ শয়ন করার পূর্ব্বে তৈয়ারও করিয়া রাখিতেন। ঘর দেখিয়া বাঙালির ঘর বলিয়া বোধ হইত না, কোনো যোদ্ধার ঘর বোধ হইতএই সকল অস্ত্র চতুষ্পার্শ্বে করিয়া এই বীরপুরুষ শুইয়াছিলেন, চোর আসিয়াছে বলিয়া জানিতে পারিলে চোরের যে কি অবস্থা হইত, তাহা অনায়াসেই অনুধাবন করা যাইতে পারে এবং চোরেরও ধন্য সাহস ও চতুরতা যে এইরূপ বিপদ এড়াইয়া সে তাহার কার্যসাধন করিতে সমর্থ হইয়াছিল।
   
তবুও এসব চৌর রীতিনীতি আজ কোথায়? চৌর-শাস্ত্র আজ অবলুপ্ত-প্রায়। দিনে দিনে তাদের চুরির প্রক্রিয়া বদলেছে, কিন্তু ভিত্তি সেই শাস্ত্রেই নিহিত। চোর তাই সমাজে আজ গুণীর আসন অলঙ্কৃত করে না, তাকে অলঙ্কৃত করা হয় অত্যাচার দিয়ে। আর এ লেখা পড়ে যাতে কারুর চোর হওয়ার বাসনা না থাকে সেজন্য আমরা শেষ করব গ্রাম বাংলায় একসময় প্রচলিত দুটো চোর-তাড়ানি শ্লোক দিয়ে। প্রথমটি এরকম:

চোর-চোরানি বাঁশের পাতা/চোর এলে তার কাটব মাথা/হুটুরপুটুর লোটা কান/চৌকিদারি ঘর উঠান/নয়া লাঙ্গল পুরানো ইশ/বন্দিলাম দশ দিশ,/বন্দিলাম ছিরাম-লখণে/ঘুরে বেরাক চোর উঠানে।
  
দ্বিতীয়টি এইরকম:
কপ্‌পোল কপ্‌পোল,
যদ্দুর যায় কপ্‌পোলের বায়,
চোর-চোট্টা না বাড়ায় পায়!
বাঁধলাম ঘর, বাঁধলাম বাড়ি,
কোন্‌ চোরা করবে চুরি!


***********************************************
গ্রন্থসূত্র:   ১। নিশি-কুটুম্ব --- মনোজ বসু
          ২। ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি --- সুকুমার সেন
          ৩। মৃচ্ছকটিক   শূদ্রক বঙ্গানুবাদ --- বরদাপ্রসাদ মজুমদার
          ৪। বাংলার ডাকাত --- যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত  
          ৫। সেকালের দারোগার কাহিনী --- গিরিশচন্দ্র বসু
                           


****************
লেখকের সম্পর্কে জানতে এই পাতায় আসুন

6 comments:

  1. Sadhu Sadhu... Physical Sicence means Physic and the science... It is truly acceptance that scientific mind can make a physic physically active to think such kinda of art in life by the pen.... No words are there to appreciate your writings...Awaiting for your more and more publication of such... Take care and be happy

    ReplyDelete
  2. দারুণ লাগলো লেখাটা

    ReplyDelete
  3. গুরু শিষ্যকে তালা ভাঙার মন্ত্র দিচ্ছেন, কিন্তু চুক্তি হচ্ছে শিষ্য কখনো মিথ্যা বলতে পারবে না। আর গুরুর কথা অবাধ্য হলে তালা ভেঙে ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই গৃহস্থ ধরবে ক্যাঁক করে-সুতরাং চরম নিষ্ঠাবান হতে হবে চোরকে।

    চমৎকার লেগেছে

    ReplyDelete