ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে
অভীক
‘সিলসিলা’ সিনেমাতে
অমিতাভ আর রেখাকে মনে পড়ে, দুজনে একটা লাল হলুদ ফুলের রাজ্যে
দাড়িয়ে গান গাইছে?... দেখা এক খোয়াব তো ইয়ে সিলসিলে হুয়ে ... হ্যাঁ, সেই
অদ্ভুত সুন্দর জায়গাটার কথাই বলছি, কিউকেনহফ, টিউলিপ এর স্বর্গরাজ্য।
নেদারল্যান্ডের একটা ছোট্ট শহর লিসে, সেখানেই এই
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান, কিউকেনহফ, এখানে বছরে প্রায় ৭০ লক্ষ টিউলিপ লাগানো হয়, তাই
যথার্থই একে বলা যায় ইউরোপের বাগান। সারা বছর ধরে তেমন কিছু হয় না, কিন্তু ঠাণ্ডাটা কমতে শুরু করলেই টিউলিপ এর সিজন শুরু হয়ে যায়। কিউকেনহফের
বাগান খোলা থাকে বছরে মাত্র তিন মাস, মার্চের শেষ থেকে মে এর
শেষ অবধি। কিউকেনহফ মানে শুধু ফুল আর ফুল, যতরকম রঙ হতে পারে
সব রকম রঙেরই ফুলের দেখা পাওয়া যায় এখানে।
আগের দিন নরডুইক -এর নর্থ সি এর তীরে সি-বিচে
কাটিয়ে রাতে ছিলাম নর্ডউইকারহাউট নামের
একটা জায়গায়। সেখানে যে হোটেলটায় ছিলাম সেটার নাম না, একটু অদ্ভুত- Stay-Okay। কিন্তু শুধু ওকে নয়, বেশ ভালোই ছিল।
পরদিন ভোরবেলা কিউকেনহফ যাওয়ার কথা, আর এই হোটেলটা থেকে
কিউকেনহফ মাত্র চার কি.মি. দূরে। তাই এইরকম একটা জায়গাকেই বেছে নিয়েছিলাম। এই সময়
মোটামুটি ৭টার মধ্যেই সূর্য ডুবু ডুবু করে। তাই হোটেলে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে একটু
ফ্রেশ হয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। সাইকেল ভাড়া করার একটা অপশন ছিল, কিন্তু আমরা হেঁটে হেঁটেই আশপাশ ঘুরে দেখবো ঠিক করলাম। জায়গাটা গ্রাম
গ্রাম টাইপের , ধু ধু করছে ক্ষেত, সেই
ক্ষেতে ফুটে রয়েছে হলুদ ড্যাফোডিল, কোথাও শুধু কুঁড়ি দেখা
দিয়েছে কোনও একটা বেগুনি ফুলের, মাঝে একটা করে খামার বাড়ি।
তবে গ্রাম বলতে আমাদের চোখে যেটা ভেসে ওঠে- কুঁড়ে ঘর, গরু
চরছে, মাটির রাস্তা- সেইরকম মোটেই নয়। এখানে প্রত্যেক চাষির
নিজস্ব গাড়ি আছে। এছাড়া চাষের জন্য রয়েছে ট্র্যাক্টর। বিরাট বড় বড় সাইজ এর বাড়ি,
সুন্দর করে সাজানো বাগান, কয়েকটা ঘোড়াও চোখে
পড়লো, দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ, সূর্য
ডুববে বলে লাল আভা ধরেছে সবে পশ্চিম প্রান্তে, এখানে আকাশ
এতটাই পরিষ্কার যে যেকোনো প্লেন গেলেই আকাশের গায়ে লম্বা লম্বা দাগ দিয়ে যায়।
কয়েকটা প্লেন যদি এপাশ থেকে ওপাশ যায় তো সারা আকাশ জুড়ে মনে হয় কে যেন কাটাকুটি
খেলে রেখেছে।
রাস্তা দিয়ে চলেছি, দুপাশে অনেক গাছপালা। অনেক সাইকেল
আরোহী পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে- হঠাৎ একটা সাইনবোর্ডে দেখি লেখা আছে ‘Invitation
– তন্দুরি বার রেস্তোরাঁ’। এখানে এসেও যে
ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ পেয়ে যাব ভাবতেও পারিনি। ডিনার এর সময় হয়নি, ৭টা মতো বাজে। কিন্তু সেই রেস্তোরাঁটা খুঁজে বের করে সেখানেই ঢুকে পড়লাম।
দেখেই মনে হলো বেশ খানদানি রেস্তোরাঁ। এমনিতেই দেশের বাইরে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁগুলো
বেশ কস্টলি হয়, এটা যে বেশ অনেকটাই বেশি হবে সেটা এর ambience
দেখেই বোঝা গেল। আমরা রেস্তোরাঁর ভেতরে না বসে বাইরে বারান্দা দিয়ে
বেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় বসলাম, সেখানে একটা বড় লেক। আমরা
একটা ছাতার তলায় গিয়ে বসলাম, রেস্তোরাঁ এর মালিক ইন্ডিয়ান
দেখে আলাপ করতে চলে এলেন। জানলাম উনি দিল্লির বাসিন্দা, প্রায়
৩০-৩৫ বছর আগে রেস্তোরাঁটি শুরু করেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন
শুটিং করতে এসে এই রেস্তোরাঁয় খেয়ে গেছেন। প্রায়ই নাকি আশেপাশে অনেক হিন্দি
সিনেমার শুটিং হয়, তাই অনেক ফিল্মি তারকাই এই রেস্তোরাঁয় ঢুঁ
মেরে গেছেন। বেশ খাওয়া দাওয়া হলো, বিদেশে আসার পর থেকে গত এক
বছরে অনেক ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয় খেয়েছি, কিন্তু সত্যিকারের
ভালো খাবার খেলাম এই অনেকদিন পরে। শেষ পাতে ফ্রিতে ফিরনি দিয়ে গেলেন ওই ভদ্রলোক,
পরের দিন আমরা কিউকেনহফ যাব শুনে নিজের গাড়ি করে পৌঁছে দেওয়ার অফার
অবধি করলেন। কিন্তু অতটা উপকার আর আমরা শেষ অবধি নিইনি। বোঝাই গেল, অনেকদিন পরে হিন্দিতে কথা বলতে পেরে বেশ আনন্দিত হয়েছেন।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে বেশ ভালোই অন্ধকার হয়ে গেল।
কনকনে হাওয়াও দিচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে, কাঁপতে কাঁপতে ৯টার সময় যখন ফিরলাম।
ততক্ষণে চারপাশ ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরাও আর বেশি দেরি না করে ঘুমিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি।
পরের দিন আমরা ৮ টা নাগাদ বেরোলাম, পেট পুরে বিশাল
ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। এই হোটেল গুলোতে ব্রেকফাস্ট এর বুফেতে এতরকম আইটেম থাকে,
খেয়ে শেষ করাই মুশকিল- যথার্থই “breakfast as a king”। হোটেল থেকে চার কি.মি.
দূরেই কিউকেনহফ, বাসস্টপটা একটু দূরে- প্রায় ১ কি.মি. মতো হেঁটে যেতে হলো, একটা বিশাল লেক পেরিয়ে এলাম। জায়গাটা অল্প উঁচু নিচু, লেকের পাশে রাস্তাটাও তাই ঢেউ খেলে চলে গেছে। পাশেই অনেক ফুলের ক্ষেত,
তবে সেগুলো তখনও ফোটেনি, কুঁড়ি হয়ে রয়েছে।
বাসস্টপে পৌঁছে টাইম টেবিল দেখলাম, প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর
একটা করে বাস। দেখলাম ঠিক ৩ মিনিট পরেই বাস রয়েছে, আর একটু
হলেই পাক্কা আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত। এখানে বাসগুলো খুব সময় মেনে চলে, ১ মিনিটও লেট করে না। আমাদের দেশে বাস তো দূরে থাক, মায়
ট্রেন, এমনকি আমাদের এত গর্বের মেট্রো অবধি টাইম মেনে আসে
না। কিন্তু নেদারল্যান্ড এর এই গ্রামেও একদম ঘড়ি ধরে ঠিক সময়ে বাসটা দেখা গেল।
কিউকেনহফ এর টিকিট কেটে চেপে বসলাম। মিনিট ১০ পরেই পৌঁছে গেলাম। সামনে পৌঁছে
দেখলাম সকাল থেকেই অনেক লোকজন ভিড় জমিয়েছে।
একটা বিশাল পার্ক, ঢুকেই দেখলাম সামনেই একটা বিশাল
কাঠের জুতো (পরে জেনেছিলাম যে নেদারল্যান্ড এর চাষি আর মিলাররা ওইরকম কাঠের জুতো
পরে থাকতো, ঠাণ্ডা আর ভিজে মাটি থেকে বাঁচার জন্য) সবাই সেই
জুতোয় পা গলিয়ে ছবি তুলছে, আমিও সেখানে পোজ দিয়ে দাড়িয়ে
গেলাম।
এর পর পার্ক এর মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে দেখলাম কত
রকম সব ফুল, বেশিরভাগই টিউলিপ, কিন্তু তার সঙ্গে হলুদ ড্যাফোডিলও
অনেক, আর রয়েছে বিভিন্ন রঙের হায়াসিন্থ, বাকি নাম-না-জানা কত রকম ফুল, কত রকম রঙ দেখে চোখ
ধাঁধিয়ে যায়। এই বাগানের পাশে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত ফুলের ক্ষেত। মনে হচ্ছে কেউ
যেন বিশাল একটা রংচঙে গালিচা বিছিয়ে রেখেছে- হলুদের স্ট্রাইপ, পাশেই লাল, তার পাশেই নীল। এ যে কোথায় এসে পড়েছি
ভুলেই গেলাম। একি সত্যি পৃথিবী নাকি স্বর্গ!
একটা গ্রীনহাউস আছে বিশাল বড়। সেখানে যতরকম টিউলিপ
হয়, সবরকম
স্যাম্পল ফুটে রয়েছে কিছু কিছু করে। সব ফুলের ছবি তুলতে তুলতে কোমরে ব্যথা হয়ে
গেল রীতিমতো। এখানে টিউলিপ নিয়ে একটু ফান্ডা দিয়ে দেওয়া যাক- ফুল যখন ফুটবে তার
ওপরে ভিত্তি করে মূলত ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যেগুলো সিজন এর শুরুতেই ফোটে- আর্লি
ব্লসম টিউলিপ, যেগুলো মাঝামাঝি ফোটে- মিড ব্লসম টিউলিপ আর
যেগুলো একদম শেষের দিকে ফোটে- লেট ব্লসম টিউলিপ। এদের মধ্যে আবার আরও ভাগ আছে। এই
সব মিলিয়ে মোট ১৬ রকম টিউলিপ হয়।
এখানে ফুলের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে একটা বোট ট্যুর হয়, মোটামুটি ৪৫
মিনিটের একটা ট্যুর। ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে সরু ক্যানাল আছে। তার মধ্যে দিয়ে বোটটা
যায় আস্তে আস্তে। ক্যামেরা বের করে যেকোনো দিকে তাক করে শাটার টিপলেই এক একটা
ওয়ালপেপার। সেই ট্যুরটা থেকে অনেক গল্প জানতে পারলাম। টিউলিপ প্রেমের ফুল, তার মধ্যে কালো টিউলিপ সবচেয়ে অভিজাত। প্রত্যেক রকম ফুল রাখার জন্য আলাদা
আলাদা ফুলদানি আছে, যেকোনো ফুলদানিতে রেখে দিলে তার
সৌন্দর্যই ফুটবে না। সেই ফুলদানিগুলো আবার বেশ দামি হয়, সাধারণ
মানুষের নাগালের বাইরে। টিউলিপের দামই এত বেশি, তাই সেগুলো
যারা কিনবে তাদের সেই ফুলদানি কেনারও সামর্থ্য থাকবে। সতেরশো শতাব্দীর শেষ থেকে
হল্যান্ডে টিউলিপ এর চাষ শুরু হয়। বাগান সাজানোর জন্য শুরুতে ব্যবহার হত, খুব তাড়াতাড়ি এর চাহিদা আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়। টিউলিপ এর বাল্ব অস্বাভাবিক
বেশি দামে বিক্রি হতে শুরু করে। ১৬৩৬-৩৭ নাগাদ হল্যান্ড এর টিউলিপ নিয়ে উন্মাদনা
চরমে ওঠে। কিছু কিছু টিউলিপ এমন ছিল যার দাম আমস্টারডামের একটা বাড়ির থেকেও বেশি ছিল। তাই সব লোকজন সব
ফেলে টিউলিপ এর চাষ শুরু করে। ঘটি-বাটি-বাড়ি বেচে সবাই টিউলিপ লাগাতে শুরু করে।
শেষে এমন হয় যে সবাই প্রায় টিউলিপ এর চাষ করছে। বাজারে এত এত টিউলিপ আর এত বেশি দাম, ডিমান্ড-সাপ্লাই রুলে এটা বেশিদিন চললো না। অচিরেই
ফুলের দাম হু হু করে পড়ে যায়। টিউলিপ চাষিরা সবাই পথে বসে। এরপর সরকার থেকে টিউলিপ
চাষের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা হয়।
এই সব গল্প শুনে মনে হচ্ছিলো, আমিও কয়েকটা টিউলিপ
গাছ নিয়ে এসে নিজের বাগানে লাগাই, বেচতে যাবোনা হয়তো,
কিন্তু বউকে তো ইমপ্রেস করা যাবে!
পুরো ট্যুরটা জুড়েই ছবি তুলে গেলাম। যেদিকেই তাকাই
সেদিকেই ফুল, একটা জায়গায় প্রায় মাইল খানেক জুড়ে শুধু লাল আর লাল। দেখে মনে হচ্ছিলো যেন
আগুন লেগেছে।
ঘোরা শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে গেল। খিদে পাচ্ছিলো
বেশ। পার্ক এর মধ্যেই ফুড পার্ক আছে, সেখানে গিয়ে একটা চাইনিজ কাউন্টার থেকে
চাউমিন এর অর্ডার দিলাম, অবাক হয়ে দেখলাম কাউন্টারে যে লোকটা খাবর সার্ভ করছে, সে দিব্যি হিন্দিতে কথা বলছে।
একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার পার্ক এর মধ্যে ঘোরাঘুরি
করতে শুরু করলাম। এত বড় পার্ক, দেখে শেষ করতেই সারাদিন কেটে গেল। পার্ক এর মাঝে একটা
বড় লেক আছে, তার চারিদিকে প্রচুর ফুল ফুটে আছে। জলের মধ্যে
কৃত্রিম স্টেপিং স্টোন বানিয়ে বানিয়ে রাখা, পাশ দিয়ে বড় বড়
রাজহাঁস ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই স্টেপিং স্টোনে পা ফেলে ফেলে লেক এর এক প্রান্ত থেকে
আর এক প্রান্তে চলে এলাম। Souvenir-এর দোকান থেকে টুকটাক
কেনাকাটা করলাম। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে হয়ে এলো, ফেরার আগে
লেকের সামনে একটা বেঞ্চে বসে চারপাশটা আর একবার ভালো করে দেখে নিলাম, ক্যামেরাতে তো এতক্ষণ অনেক ছবি উঠেছে, মনের
ক্যামেরায় আর একবার ছবিগুলো তুলে নিলাম। ফেরার বাসের সময় হয়ে এসেছিল, আমরা উঠে পড়লাম।
এই বছর অক্টোবর নাগাদ প্রথম বাল্ব লাগানো হবে
অফিসিয়ালি, এটাই হবে শুরু, তারপর একে একে ৭০ লক্ষ এর বেশি ফুল
লাগানো হবে - টিউলিপ, ড্যাফোডিল আর হায়াসিন্থ, যাতে আবার ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে - ভরে যায় পরের বসন্ত। তাই যারা দেখতে চান,
এপ্রিল নাগাদ একবার অবশ্যই ঘুরে আসুন , এ
জিনিস না দেখা মানে জীবনে অনেক কিছুই না দেখা রয়ে যাওয়া।
ইস্, এই জায়গাটা ঘোরা হয় নি। কুছ পরোয়া নেই, বাদ মে হোগা। যেটা মিসিং, সেটা হলো কিছু ম্যাক্রো ছবি। অন্ততঃ ২টো ক্লোজ ছবি দাবি করে এই লেখাটা।
ReplyDeleteথুড়ি, ক্লোজ-আপ হবে ওটা।
ReplyDelete