কালকের খবর

নির্মাল্য















সকাল থেকেই শরীরটা ভালো লাগছিল না অনিমেষের। ডাক্তারি পেশায় বহুদিন ধরেই অনেকের শরীর খারাপের সমাধান করেছেন তিনি। ঠিক শরীর খারাপ বলা চলে না। বলা ভালো মন খারাপের সমাধান। মন খারাপই বটে। কাউন্সেলরকে এখনও অনেকেই ডাক্তার বলে মনে করেন না। কেন কে জানে! অথচ মন খারাপ হওয়াটা শরীর খারাপের থেকে অনেক বেশি কষ্টদায়ক। যে সেই কষ্ট ভোগ করেছে একমাত্র সেই জানে। যাকগে, এই নিয়ে অনিমেষের কোন অভিযোগ নেই। তার রুগিরা বেশিরভাগই তাঁর পরামর্শে সন্তুষ্ট। তার চিকিৎসায় মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছেন এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। একমাত্র একজনেরই খবর তিনি জানেন যে এর পরেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। প্রতীক বসু। একসঙ্গে তিনজন নারীর সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনে তার আর কিছু করারও ছিল না। যাক সে কথা। কিন্তু আজকাল তাঁর নিজের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। কেন কে জানে, তার মন খারাপ করছে। একটা অজানা ভয় চেপে বসেছে।

সোনারপুরের এই বাড়িটা কেনা তাঁর সাধ্যাতীত ছিল না মোটেই। জীবনে অনেক রোজগার করেছেন। তাতে কলকাতার একটা ফ্ল্যাট কেনা মোটেই অসম্ভব ছিল না। কিন্তু এই জমিটার মাটির রঙ হলুদ। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু এই হলুদ রঙের জন্যই জমিটা তাঁর এক দেখায় পছন্দ হয়ে গেছিল। তার মনে আছে, মা বলতেন হলুদ নাকি মাথা ঠাণ্ডা করে। ছোটবেলায় যখন চুল কাটতে চাইতেন না, জোর করে মাথা নেড়া করানো হতো। খুব রেগে থাকলে মা হলুদ বেটে লাগিয়ে দিতেন মাথায়। অনেককে এই পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। একা মানুষ, বিয়ে থা করেন নি, তাঁর অবর্তমানে এই বাড়ির কি হবে? জমানো টাকারই বা কি হবে? এসব ভাবনায় না গিয়ে কন্ট্রাকটর লাগিয়ে ছোট্ট বাগানওয়ালা বাড়ি বানিয়ে নিয়েছিলেন এক বছরের মধ্যেই। ভালোই করেছিলেন। এখন এই সব আধা-মফস্বল এলাকাতেই জমির যা দাম দাঁড়িয়েছে, তাতে এই সময় হলে এতটা পারতেন কিনা কে জানে। বাড়ির সামনের বাগানটা বাঁধানো প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলতে পরামর্শ দিয়েছিল কন্ট্রাকটর, রাজী হননি অনিমেষ। খোলামেলা রাখতে আদ্যিকালের কঞ্চির বেড়া দিয়েছেন। তাতে খোলামেলা আছে বটে, কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে গরু ঢুকে পড়ে। কি মুশকিল! অমন সাধের দোপাটির চারাগুলো... কত সাধ করে লাগিয়েছিল সন্ধ্যা।

সন্ধ্যা, তাঁর দু’বেলার ঠিকে কাজের লোক। দু’বেলার বলা ভুল হবে। সন্ধ্যা দিনের বেশিরভাগ সময়টা এখানেই কাটায়। তার একটি মেয়ে। ছেলেটা অপুষ্টিতে মারা গেছে জন্মের পর পরই। তারপরই সন্ধ্যার এই কাজটা নেওয়া। মেয়েটাকেও একই পরিণতির হাত থেকে বাঁচাতে। মেয়েটা বেঁচেছে। নিঃসন্দেহে তারা এখন অনেক সুখী। বিলু রিক্সা চলায়। নিজের নয়, মালিকের। যে ক’টা টাকা আয় হয়- মদেই সবটা উড়ে যায়। মানুষটার শরীরে আর কিছু নেই। কোনদিন অ্যাক্সিডেন্টে যদি বিলুর মরার খবর আসে, সন্ধ্যা এতটুকু আশ্চর্য হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, এতে তার আর কিছু আসে যায় না। ভাত দেবার মুরোদ যার নেই, তাকে নিয়ে আর আশাই বা কি, আর তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার দায়ই বা কি?

সত্যি বিশ্বস্ত আর তার থাকা হয় নি। বাবু এখনও হাট্টাকাট্টা, কি সুন্দর দেখতে। এতটা বয়স হয়েছে বোঝাই যায় না। সে শুনেছে বাবু নাকি পাগলের ডাক্তার ছিলেন। ভালো কথা। এই বাজারে সারাদিনে একটা মানুষের কাজের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা কেউ দেবে না মাসে। এতে তার ঝুমকীর লেখাপড়ার খরচ সেরেও হাতে অনেকটা থাকে। বাবু পুজোয় তার জন্য, ঝুমকীর জন্য জামাকাপড় দেন। পুজো ছাড়াও এটা-সেটা বাবদ বাবুর কাছে হাত পাতলেই চলে। প্রথম ছ-মাসে দু’একবার বাবুর জামাকাপড় কাচার সময় দশ-বিশ টাকা সে সরিয়ে নেয়নি এমনটা নয়। কিন্তু পরে দেখেছে বাবুর কাছে চাইলেই এর চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যায়। শুধু শুধু চোর হতে যাবে কেন? বিলুর অবশ্য অন্য মত। এসব পাগলের ডাক্তার নাকি নিজেরাও খানিকটা পাগল হয়। কাজেই মাথা ঠিক থাকতে থাকতেই যতটা পারা যায় নিজেরটা গুছিয়ে নিতে পরামর্শ ছিল তার। লজ্জা করে না? নিজের মাগ-ছেলেকে খাওয়াতে পারিস না, তুই চুরি করতে সঙ্গ দিস? তোর মরণ জোটে না? শালা শুয়ারের বাচ্চা। রাতে আসিস ঘষতে, ঝেঁটিয়ে তোর মুখ ভেঙে দিবো। ঝুমকী আর তার জন্য নিচের ঘরটা একরকম ছেড়েই দিয়েছে বাবু। সারা বাড়িতে তার অবাধ গতিবিধি। রান্নাঘর, ব্যালকনি... বাবুর তো কোন আত্মীয় স্বজন নেই। কতদিন এমন হয়েছে রাতে আর সে ঘরে ফেরে নি। ঝুমকী ইস্কুল থেকে সোজা চলে এসেছে বাবুর বাড়ি। আর রাতে বিলু কোথায় থাকল? কি খেল? মরুক গে যাক। দেবতার মতন মানুষ তার বাবু। এমন মানুষের জন্য সব করা যায়। স-অ-অ-অ-ব। বিলু জানে। একদিন তাকে একটু কাছে টেনে এই কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল সে। -

-হ্যাঁরে সুনু, তর বাবু তরে খুউব ভালোবাসে, লারে? - 
-তর তাতে কি’রে মিনসে, মুখপোড়া, রাতবিরেতে জ্বালাসনি, কাল বাবুর ঠেনে সক্কাল সক্কাল যেতে লাগব। বাবু মিটিনে যাবেক।
- শুধু বাবু আর বাবু। সুনু, হামি তর কেউ লা রে? তর সোয়ামি হামি। হামি মরে গেলেক বেধ্‌বা হবি র‍্যা। হক কথা কইছি। -
-মর তো আগে। এখুন জ্বালাসনি। 
-কনুইয়ের ঠেলায় মাতাল বিলুকে সরিয়ে দিয়েছিল সন্ধ্যা। বাবু এমন নয়। অনেক মদ খেলেও বাবু সচল। একই রকম। প্রতিদিন না, মাঝে মাঝে এমন মানুষের সাথে সন্ধ্যার মন্দ লাগে না। তার ওপর এটাও তার একটা সংসারের মতোই। বাবুর বাড়ি একরকম তার নিজেরই বাড়ি। কিন্তু আজকাল কি যে হয়েছে, বাবু একটু অন্যমনস্ক থাকেন। এই তো সেদিন, বাবু কিসব আজেবাজে লিখছেন কাগজে। সন্ধ্যা বাড়ির মেন গেটটা লাগিয়ে বাবুর কাছে গেল।
-বাবু এট্টু অম্রুতা লেগায়ে দিমু? তমার কি মাথা ধরসে? -
-না সন্ধ্যা, কালকের ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত জানো? আমেরিকা বোমা ফেলবে। আমি জানি। আমি আজকাল রোজ জানতে পারি। আমি কিছুই করতে পারি না। জানো কত লোকের কাল কি হবে, সব আমি বুঝতে পারি?
-আপনে দাক্তার মানুস। আপনে বোঝবেন লা তো ক্যা বোঝবে? 
-না সন্ধ্যা। সেরকম না। আমি একদম ছাপার অক্ষরের মতো জানতে পারি। আগে জানলে আমি প্রতীক বোসকে কিছুতেই মরতে দিতাম না।

এই এক হয়েছে। প্রতীক বোস। বাবু বলেন সে নাকি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। মরেছে, আপদ চুকেছে। পাঁচটা মেয়েমানুষের সাথে ছেনাল করে বেড়াবি, তোর মরাই উচিত। বাবু এঁকে নিয়ে অ্যাদ্দিন কিছুই বলতেন না, আজকাল যে কি হয়েছে। খাওয়ায় মন নেই। শুধু ঐ এক কথা। কালকে কি হবে? সেই প্রতীক বোস...উফ্‌ ভগবান, আমার সুখ কি তোমার সয়না? স্বামী হয়েছে মাতাল, আর এই ভালোবাসার মানুষটা, এটাকেও তুমি কি কেড়ে নিতে চাও? বাবুর বাড়িতে একদিন বারের পুজা দেবে ঠিক করেছে সন্ধ্যা। নিজের বাড়িতে কোনদিন সামর্থ্যে কুলায় নি। বাবুর বাড়িতে এই শখ মিটিয়ে নেবে সে। ঝুমকীর বন্ধুরা, ওপাড়ার নিমকি, মাছওয়ালি সুলতা সবাইকে ডাকবে। সবার চোখ টাটাক, সবাই হিংসায় জ্বলুক। এই আস্তানা তার নিজস্ব। নাই বা হলো সাতপাকে বাঁধা।

সন্ধ্যা মুখ ভার করে চলে যায়। বাটনা বাটতে বসে। গুঁড়ো মশলার রান্না বাবু পছন্দ করেন না। আবার শিলনোড়ার ঐ জায়গাটার কাছে বাবু একগাদা কাগজপত্র জমা করে রেখে দিয়েছেন। মশলার দাগ লেগে লেগে কাগজগুলো হলুদ হয়ে গেছে। বাবুকে না জানিয়েই একদিন এসব ঝেঁটিয়ে ফেলে দেবে সন্ধ্যা। আপাতত বাবুর আর ঝুমকীর জন্য দুধ ফুটিয়ে রাখতে হবে ফ্রিজে ঢোকানোর আগে। আর ওবেলা একটু হাল্কা করে আলু-কুমড়োর ঝাল করে নেবে। আজ আর বাড়ি যাবে না। ঝুমকী এখানেই খেয়ে শুয়ে যাবে। রাতে দু’জনেই রুটি তরকারি আর দুধ। বৃষ্টি না হলে পাড়ার দোকান থেকে দুটো করে মিষ্টি আনার ইচ্ছে আছে। মানুষটা যদি একটা রুটি বেশি খায়...অনিমেষের মন নেই খাওয়ার মেনুতে। রাতে কিছু একটা দিয়ে পেট ভরালেই হলো। আর অন্য কোন প্রয়োজনে সন্ধ্যা কখনো বাধা দেয় নি। তার নিজের প্রথম প্রথম বাধো বাধো ঠেকেছে বটে, কিন্তু সন্ধ্যা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। ও থাকতে কোন সমস্যা নেই।

সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হল খবরের কাগজ। হ্যাঁ, সামান্য একটা দৈনিক সংবাদপত্র ঘুম কেড়ে নিয়েছে প্রথিতযশা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের। সমস্যাটা বিশেষ কিছুই নয়। প্রতিদিন সূর্যের আলো ফোটার আগে মর্নিং ওয়াকে যাওয়াটা তার অভ্যাস। মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় থেকেই। আজও আছে সেই স্বাস্থ্যবিধি। সেদিন মহালয়ার আগের রাতে দেখলেন সোনারপুরেই পাঁচপোতার মোড়ে কয়েকটা লোক লাল রঙের একটা শহিদ বেদি না কি যেন একটা ভাঙছে। সবুজ পতাকা গোটানো আছে একপাশে। ইট, সিমেন্ট সবই মজুদ। ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হলো না। এখন রাজনৈতিক পালাবদল একরকম নিশ্চিত। একদল গিয়ে আরেকদল সিংহাসনের দখল নেওয়াটা সময়ের অপেক্ষা। অন্ততঃ টিভি নিউজ তাই বলছে। এরকম সব ঘটনা যে হবেই তাতে আর আশ্চর্য কি। একটু ক্লান্ত হয়েই বাড়ি ফিরে আসেন অনিমেষ। আশ্চর্য! মর্নিং ওয়াকের পর তো এমন ক্লান্ত লাগার কথা নয়।

সন্ধ্যা আসেনি এখনও। আরও আধঘণ্টা পর আসবে হয়তো। নিজেই চা ফুটিয়ে নেন তিনি। সন্ধ্যার জন্যও। একটু পরে বাইরে বেরিয়ে দেখেন পড়ে আছে সকালের খবরের কাগজ। বারবার বলা সত্ত্বেও সেই বাগানেই ছুঁড়ে দিয়ে যায় কাগজখানা। তুলে নিয়ে একটু ঝেড়ে নেন তিনি। হেডলাইনে চোখ আটকে যায় তার। “সোনারপুরে রাজনৈতিক সংঘর্ষে ২ জনের মৃত্যু”। কই আসার পথে তেমন কিছু মনে হলো না তো! বিস্তারিত খবরে জানতে পারলেন সমাজতান্ত্রিক নেতার শহিদ বেদি ভেঙে ফেলা নিয়ে বচসা এবং তার থেকে সংঘর্ষ। তাতেই ২ জনের মৃত্যু। চায়ের কাপে আর মুখ দিতে পারেন না অনিমেষ। এ তিনি কি দেখছেন? এই তো এক ঘণ্টা আগে দেখে এলেন ব্যাপারটার আরম্ভ। আচ্ছা, পাঁচপোতার মোড়ই বলেছে তো? হ্যাঁ নির্ভুল। তাহলে? কি হলো ঘটনাটা? ওপরের খবরের কাগজের তারিখ দেখে অবাক হয়ে যান অনিমেষ। এ তো কালকের তারিখ। মানে, আগামীকাল! এ কি রকম খবরের কাগজ?

সন্ধ্যা এসেছে। দরজা খুলে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। হতভম্ব দৃষ্টিটা তখনও কাটেনি। -

-কি হল বাবু? শরীল খারাপ? -
-না, তুমি এস। ঝুমকী কই? স্কুল যাবে না? -
-আর বলেন কেনে? ইস্কুল না ঘোড়ার মাথা। এই আজ থিকাই নাকি পূজার ছুটি। আগুন দিই ইসব ইস্কুলে। গজগজ করতে করতে ভেতরে ঢুকে যায় সন্ধ্যা।

কিন্তু হিসেবটা যে কিছুতেই মিলছে না। সন্ধ্যাকে বলবেন নাকি একবার? নাহ্‌ থাক। সে কি বুঝতে কি বুঝবে। এমনিতেই বারের পুজো না কি একটা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এরপর হয়তো জ্যোতিষ ডেকে ভুত ঝাড়াবে। কিই বা করা যায়। সন্ধ্যার মুখের ওপর ঝেড়ে ‘না’ বলতে পারেন না যে!
বিকেলে বাজার সেরে সন্ধ্যা উত্তেজিত মুখে ঘরে ঢোকে।
-বাবু, কি হয়েচে জানেন? ও পাড়ায় মারপিট। কত লোকের মাথা ফাটছে। 

অনিমেষ সবই জানেন। সকালের খবরের কাগজ ছাড়াও বিকেল থেকে নিউজ ফ্ল্যাশ এ দেখাচ্ছে ঘটনাটা। একজনেরই মৃত্যুর খবর বলছে। তিনি নিশ্চিত, আহতদের মধ্যে একজন নিশ্চয় হাসপাতালে মারা যাবে। কিন্তু তিনি কি করবেন? কাকে বলবেন? পুরনো ছাত্র সহদেবকে একবার ডেকে পাঠালে হয়। অন্য কেউ তার কাছে এই সমস্যাটা নিয়ে এলে এক লহমায় এর সমাধান বলে দিতে পারতেন তিনি। দু’একটা নার্ভের ওষুধ দিয়ে দিলেই মিটে যেত। কিন্তু এ যে খোদ পুলিশের ঘরেই ডাকাতি! দোনোমোনো করতে করতে সহদেবকে একটা ফোন করেই দিলেন তিনি। সে আসবে বলেছে রাতে, একটু দেরি করে। রাতে সন্ধ্যাকে দিয়ে একটু ফিশ ফ্রাই ভাজিয়ে নেন তিনি। ফ্রিজে ইম্পোর্টেড হুইস্কি রাখা আছে। সহদেব ভালোবাসে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কটা একদম বন্ধুর মতো। চলে যেতে বলেন সন্ধ্যাকে।
সহদেব পুরো ঘটনাটা শোনে। বাঙ্গুর হসপিটালের বড় পোস্টে আছে সে। হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দেয় গম্ভীরভাবে।

-স্যার, আপনি শিওর, আপনি হ্যাংওভার ঠিকঠাক কাটিয়ে উঠেছিলেন? - 
-বলিস কিরে ছোকরা, আগের রাতে মাল খাই নি তো, কিসের আবার হ্যাংওভার? পেপারটা সন্ধ্যা কোথায় আবার রাখলো খুঁজে পাচ্ছি না। সত্যি, এই মেয়েটার গোছাগুছির জ্বালায় টেকা দায় হয়েছে। অবশ্য সন্ধ্যা তার সম্পর্কে কি ভাবে সেটা অনিমেষ খানিকটা জানেন। কাজেই এই নিয়ে আর কথা বাড়ান না।
-স্যার, নেক্সট টাইম এরকম কিছু ঘটলে কাগজটা হারাবেন না। বলা যায় না, আপনি এলাকার একজন গণ্যমান্য লোক। ইচ্ছে করেই হয়তো কেউ এই কাজ করেছে। হয়তো ওই দুই দলেরই কেউ। এরপর আপনার ঘাড়ে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ চাপানোও অস্বাভাবিক নয়। একটা জেনারেল ডায়েরি করে রাখা ভালো।

নাহ্‌, সহদেবকে এতটা হুইস্কি খেতে দেওয়া ঠিক হয়নি। কি সব বলছে মদের ঘোরে। তাকে এখানকার সবাই খুব ভালোবাসে। কেই বা তাকে বিপদে ফেলতে চাইবে।
-আচ্ছা, স্যার, আপনি কি কোনো কারণে খুব বেশি ফ্রাস্ট্রেটেড? মানে কোনো না পাওয়া? কোনো বাসনা...
বোঝ, হাতে ধরে ক্লাস নিয়ে শেখানোর কি ফল! নাহ্‌ আজ আর সহদেবকে দিয়ে কোন কাজের কথা হবে না।
-সহদেব, যাও ঘুমোতে যাও, আর খেও না।
-স্যার, আপনার কাছে সিগারেট আছে? একটা?

নীরবে সিগারেট বাড়িয়ে দেন অনিমেষ। নিভু নিভু আলোয় টলতে টলতে সিঁড়ির দিকে চলে যায় সহদেব। আবার টিভি খোলেন অনিমেষ। সেই একই খবর। কতক্ষণ যে এটা ব্রেকিং নিউজ থাকবে কে জানে? বিশেষতঃ তার কাছে তো নিতান্তই বাসি। 

কাকভোরে উঠে চলে যায় সহদেব। তার ডিউটি আছে। চোখ তখনও লাল। কোনমতে দরজা লাগাতে ওঠেন অনিমেষ। নাঃ আজ আর শরীরটা ভালো নেই, মর্নিং ওয়াকে আজ যেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া লাল মেঘ দেখতে পান আকাশে, আজকাল ঋতু-চক্র বলে সত্যি আর কিছু নেই। যখন তখন বর্ষা, কাঠফাটা গরম... দরজা লাগাতে গিয়ে বাগানে চোখ পড়ে তার। সহদেবের আর জ্ঞানগম্যি হলো না দেখছি। বাইকটা রেখেছিল এমন ভাবে ঠিক পাতাবাহারের চারাগুলোর ওপর। আহা রে, আর কি বাঁচবে? খালি পায়েই বাগানে নেমে যান অনিমেষ। ভোরের আলো ফুটবো ফুটবো করছে। এ কি! এত ভোরে কাগজ চলে এসেছে? তাহলে আজকেও কি... ভয়ে ভয়ে কাগজটা হাতে তুলে নেন তিনি। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই, কাগজে আগামীকালের তারিখ লেখা। শিরোনাম- “দিনভর বৃষ্টিতে নাকাল মহানগরী”, সাব-হেডিং এ বলছে পুজোয় ভাসবে রাজ্য। কেমন একটা গা শিরশির করে ওঠে অনিমেষের। সহদেবকে এখনই কি ডেকে নেবেন? নাহ্‌, থাক, বেচারা এমনিতেই ঠিকঠাক অবস্থায় নেই, তারপর আবার বাইকে অ্যাক্সিডেন্ট না করে বসে। দু’এক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ঢুকতে যান তিনি। চেনা গোয়ালা তাঁকে ওভাবে দেখে সাইকেল থামিয়ে দাঁড়ায়।

-কি হলো ডাক্তারবাবু, কিছু হয়েছে? 
-না,না, একজন এসেছিল, তাকে ছাড়তে বেরিয়েছিলাম।
-ওঃ, আচ্ছা চলি।
-হ্যাঁ শোন, আমার বাড়িতে যে কাগজ দেয়, তাকে তুমি চেনো? -
-হ্যাঁ চিনবো না কেন? বিকাশ তো।
-ওকে একবার পাঠিয়ে দিও তো।
-ঠিক আছে, কোন অসুবিধা হয়েছে?
-না না, এমনি আসতে বোলো।

অসুবিধে সত্যিই তেমন কিছু হয় নি। পুজোয় বৃষ্টি হলে তার আর কি? কিন্তু সন্ধ্যা বলছিল তার দেওয়া পুজোর জামাদুটো খুব পছন্দ হয়েছে ঝুমকীর। বেচারা আনন্দ করতে পারবে না। কিন্তু সেসবের থেকেও বড় ব্যাপারটা হলো, তার কি হবে? এভাবেই কি চলতে থাকবে? পরের দিনের খবরের কাগজ! দেবতা-ভূতে বিশ্বাস করেননি কোনদিন। বিশেষতঃ মনোরোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে বুঝেছেন যে মানুষের জীবনে কনফিডেন্সের অভাব ঘটায় এই অস্তিত্বহীন জিনিসগুলোই। এই যেমন প্রতীক বোস। তার তিনটি সম্পর্কের মধ্যে একটি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। ভালোভাবেই। মানে দু’জনেই আলাদা ভাবে সুখী হতে চলেছিল। কোথা থেকে ধর্মভয় এসে পেয়ে বসল প্রতীককে। ব্যস্‌, তারপরেই আবার সেই মেয়েটির সংসারে উত্ত্যক্ত করা, অকারণ বারবার ক্ষমা চাওয়া... শেষ পরিণতি তো সকলেরই জানা। হ্যাঁ, সকলেরই। এই দৈনিকেই ফলাও করে বেরিয়েছিল খবরটা। হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা মনে হয় অনিমেষের। আচ্ছা, এরকম যদি তিনি আগের দিনই জানতে পারতেন খবরটা, তাহলে কি হতো? তিনি নিশ্চয় আটকে দিতেন প্রতীককে। আচ্ছা, তাহলে খবরটার কি হতো? মিথ্যে খবর বেরতো? ঐ খবরটার সময় তাঁর দু’একটি কথা বেরিয়েছিল কাগজে। কিন্তু সাংবাদিক ব্যাটা অতি সাবধানে এড়িয়ে গেছিল তাঁর নাম। যদিও তাঁর নিজের বহুদিনের ইচ্ছে যে খবরের কাগজে তাঁর নাম বেরোয়। 

অস্থির ডোরবেলের শব্দ পান তিনি। তাড়াতাড়ি দরজা খোলেন। সন্ধ্যা বাইরে ভিজছে। মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। নাঃ, প্রতীককে তিনি আটকাতে পারতেন না। এই তো বৃষ্টি নামল। তার ইচ্ছেয় কিছু হল কি? -

-কি হল বাবু, সরেন...তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ভিজে আঁচল ঠিক করতে করতে বলে সন্ধ্যা, হালকা একটু হাসলও কি? কে জানে? সন্ধ্যা জানে না, তাঁর আর খুনসুটির বয়স নেই। আর ইচ্ছে, এখন অন্ততঃ একটুও নেই। 

দুপুরে মাছের কালিয়া খেতে খেতে একটা অদ্ভুত কথা মনে হয় তার। আচ্ছা, লটারির টিকিট কাটলে কেমন হয়? মানে কাগজে তো প্রতিদিন লটারির ফলাফল বেরোয়ই। সেটা তিনি আগের দিন থেকেই জানেন। সেই নির্দিষ্ট নম্বরের টিকিটটা কাটলেই হলো। ব্যস্‌, অনিমেষকে আর পায় কে? কিন্তু কি হবে এত টাকা? ভি আর এস নেওয়ার পর অনেক টাকা এখনও তার জমানো। কেই বা নেবে? ঝুমকীর জন্য কিছু দেবেন তিনি। বাকিটা ভারত সেবাশ্রমকে... নাঃ, সন্ধ্যার জন্যও কিছুটা দিলে... তাহলে লটারি কাটবেন শেষ অবধি? ভাবতেই হাসি পায় তার।

-খেতে খেতে এত হাসি কি স্যার? রান্না ভালো হয়নিকো?
-না, না, মাছটা খুব ভালো হয়েছে। -আর একখান দিমু নাকি?
-না, ঝুমকী এলে দিও
-অর কথা ছাড়ান দ্যান। আসবার সময় কুত্ত করে কইনু চ, ওখানে থাকবি, টিভি দ্যাখবি। বাপ কইল, পরে দিয়া যাবেখন।
-তাহলে আজ আর ওর না আসাই ভালো। খুব জোর বৃষ্টি নামবে সন্ধ্যা। খুব জোর। বিলুও বিপদে পড়বে।
-সে হবেখন, আপনে খান। খায়া-দায়া এট্টু শোন দেখি। মাথা টিইপ্যা দি। আপনারে কেমন য্যান রুগি রুগি দ্যাখত্যাছে।
-বলছ? আচ্ছা দিও। নীরবে মেনে নেন তিনি। সত্যি, এই একমাত্র তার খেয়াল রাখে। এই তো সহদেব এল, মাল খেল, দুটো বাজে বকে চলে গেল। আবার রাজ্যের জ্ঞানের কথা শুনিয়ে দিয়ে গেল। পাগল ছেলেপিলে সব। কিন্তু সন্ধ্যার কি হলো? তার এতবড় ভবিষ্যৎবাণীটাকে কোনরকম গুরুত্বই দিল না!

রাত শেষ। সন্ধ্যা অনেকক্ষণ নিচের ঘরে চলে গেছে। আজ আর তার কোন চিন্তা নেই। সারারাত যা বৃষ্টি হয়েছে, আজ কোন খবরের কাগজ আসার ভয় নেই। সন্ধ্যা কিছু অল্পস্বল্প বাজার করতে যাবে বলে বেরোল। দরজা লাগাতে গিয়ে ভেজা স্যাঁতসেঁতে কাগজের পিণ্ডটা দেখে থমকে দাঁড়ালেন অনিমেষ। আজও?

তিনদিনের মাথায় কোন কিছুই আর অস্বাভাবিক লাগে না তার। সন্ধ্যা না জানি কেন আজও বকবক করে চলেছে তার স্বাস্থ্য নিয়ে। অথচ তার একটুও অসুবিধে মনে হচ্ছে না। দিব্যি আছেন। জানেন রাত পোহালেই হাতে চলে আসবে গরমাগরম কালকের খবর। টিভিটা একটু চালালে হয়। ওঃ, ঝুমকী ইতিমধ্যেই রিয়েলিটি শো নিয়ে বসে পড়েছে। নাহ্‌ তাঁর কোন চান্স নেই। আলতো করে ঝুমকীর মাথায় হাত বুলিয়ে ওপরে চলে যান অনিমেষ। রান্নাঘর থেকে সন্ধ্যা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করে তিনি এখন কিছু খাবেন কিনা। না, জানিয়ে ওপরের বিছানায় শুয়ে পড়েন তিনি। এবারের পুজোসংখ্যাটা তেমন সুবিধের করে নি। শুধু আজেবাজে উপন্যাস আর বটতলার কাছাকাছি ছোটগল্প। ইস্‌, এই ব্যাপারটা যদি কয়েকমাস আগে ঘটতো, তাহলে তিনি নিজেই কোন একটা পুজোসংখ্যায় লিখে ফেলতে পারতেন। সবাই অবাক হয়ে পড়তো। তাঁর প্রাক্তন রুগিরা, সন্ধ্যা, সব্বাই।
হঠাৎ প্রতীক বোস বলল- ডাক্তারবাবু, মনে হচ্ছে গল্পটা তেমন জমবে না, বুঝলেন। 

-প্রতীকবাবু, আপনি? আপনি তো?
-আমার কথা বাদ দিন। আপনি লেখাটেখা তেমন একটা করে উঠতে পারেন না, বুঝলেন?
-কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? আপনি তো গলায়...
-সেসব আমার কপালে ছিল। আসলে আমি নাটকটার মঞ্চে ছিলাম কিনা। উইংসের ওধারের লোকেরা তেমন ভুগল না, আমিই ভুগলাম।
-মানে? কি সব বলছেন আপনি? শুনুন, আমি এই ওষুধ দুটো লিখে দিচ্ছি...
-আর ওষুধ, আসলে কপালটাই আমার খারাপ। এই দেখুননা, আপনি উইংসের ওধার থেকে কেমন দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন। গলায় দড়িটা হয়তো বিলুর জন্যই...
-গেট আউট। এখুনি বেরিয়ে যান আমার চেম্বার থেকে। মস্করা মারবার জায়গা পান না? হাউ ডেয়ার ইউ? আপনার সাহস কি করে হলো এটা নিয়ে আমার সাথে কথা বলার?
-রেগে যাচ্ছেন ডাক্তারবাবু? রাগলে কি আর সত্যিটা চাপা যায়?
-প্রতীক, আপনি বেরিয়ে না গেলে আমি হাত তুলতে বাধ্য হব।
-বাবু, বাবু ও বাবু।

সন্ধ্যার ডাকে ঘুম ভেঙে যায় অনিমেষের। পুজোসংখ্যাটা উলটে পড়ে আছে মেঝেতে। কখন যে চোখ লেগে গেছিল...
- কি হলো সন্ধ্যা? -আপনের কাগজের লোক এয়েছে? আপনে ডাক দ্যাছিল্যান?
-ওহ্‌, বিকাশ?
তড়িঘড়ি উঠতে যান তিনি। হঠাৎ করে ভাঙা ঘুমেই হয়তো মাথাটা টলে যায়, উঠতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া এখন বিকাশের সাথে এই নিয়ে কথা বললে সন্ধ্যা সব শুনবে। তারপর হয়তো ওঝা ডেকে... নাহ্‌ থাক।

-ওকে পরে আসতে বোলো। বোলো আমি দরকার হলে আবার ডেকে পাঠাবো। আর শোন, আমার মানিব্যাগ থেকে একশ টাকা বার করে ওকে দিয়ে দাও। পুজোর বখশিশটা।
-কাগজ মাগজ তো পড়েনই না। ক্যান যে ন্যান? পাঁচশো টাকার একটা নোট বার করে নিয়ে যায় সন্ধ্যা।

সন্ধ্যা আর কি বুঝবে কাগজ তিনি কখন পড়েন, আর কোন কাগজ পড়েন। যাক, সে সব ওকে বুঝিয়েও কাজ নেই। আজকের, মানে আগামীকালের কাগজেও দেখেছেন চাঁদা আদায় নিয়ে বচসার জেরে মারামারি। থানা-পুলিশ। জায়গাটার নাম ঠিকঠাক মনে পড়ছে না। একটু পরে টিভিতে দেখলেন সেটা শিলিগুড়ি। মনে মনে হাসলেন তিনি। সত্যি, নিউজ চ্যানেলের অজ্ঞাত রিপোর্টার হলে কেমন হয়? চ্যানেল লুফে নেবে তাকে। আবার হাসি পেল তার। এছাড়াও খুঁটিয়ে পড়েছেন নাবালিকাকে ধর্ষণের জেরে যুবকের শাস্তি, চোর সন্দেহে গণপ্রহারে মৃত্যু। এসব কই টিভিতে দেখাচ্ছে না তো? আসলে এমন ঘটনাগুলো ঠিকঠাক কোন সময়ে ঘটেছে সে সব লেখা ছিল না কাগজে। এখনো ঘটে নি বোধহয়। তবে হ্যাঁ রাতের আগেই ঘটবে নিশ্চয়। না হলে কাগজে বেরোবে কি করে?

পুজোর মাত্র আর দু’দিন বাকি। বৃষ্টি আজ রাতেও হয়েছে। দু পেগ হুইস্কি খেয়ে ফুরফুরে মেজাজে আছেন অনিমেষ। সন্ধ্যা জানিয়ে দিয়েছে পুজোর ক’দিন ঝুমকীকে নিয়ে সে এখানেই থাকবে। কলকাতার কাছে, ঠাকুর দেখতে সুবিধে হবে, এছাড়াও বিলুকে নাকি পুজোর ভিড়ে একটু বেশি রোজগারের জন্য রাতভর রিক্সা টানতে হবে। তাই আজ সন্ধ্যা বাড়ি গেছে। কাল একেবারে সব নতুন জামাকাপড় নিয়ে সকাল সকাল-ই চলে আসবে। এখন রাত তিনটে। জানলার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন তিনি। আজ তিনি বিকাশকে দেখতে পেলেই কথা বলবেন। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আছে চারদিক। কে একজন সাইকেলে করে এসে দাঁড়াল। কাগজটা ছুঁড়ে দিল। ভালো বুঝতে পারছেন না। বিকাশই কি? আচ্ছা, প্রতীকের মত লাগলো না খানিকটা?
-কে ওখানে? এই, দাঁড়াও...

উঠতে গিয়ে বুঝতে পারেন হুইস্কি টেনে ধরছে তাকে। কোনমতে এক পা এক পা করে দেওয়াল ধরে ধরে নিচে নামেন প্রায় দশ মিনিট ধরে। দরজা খোলেন। একি! এরই মধ্যে গরুতে খেয়ে গেল কাগজটা? এত বৃষ্টিতে গরুই বা এল কোথা থেকে? ভিজে কাগজটার প্রথম দুটো পাতা একেবারে পড়ার অযোগ্য হয়ে গেছে। তারপরের পাতাগুলোতেও এ বাড়ির হলুদ কাদা লেগে আছে। উফ্‌ কি করে পড়া যায় কালকের খবর?

রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যান অনিমেষ। রুটি সেঁকার তাওয়াতে হাল্কা গরম করে নিলে কি একটু শুকোবে? রান্নাঘরে ঢুকলেই সন্ধ্যার অস্তিত্ব টের পান তিনি। ঐ শিলনোড়াটায় বিশেষ করে, সন্ধ্যার হাতের ছোঁয়া এখনও লেগে আছে মনে হয়। আচ্ছা, সেদিন স্বপ্নে প্রতীক বোস যা সব বলল, সেগুলো কি সত্যি? খানকক্ষণ পরে ভেতরের একটা পাতায় চোখ যায় তার। ধপ্‌ করে বসে পড়েন মেঝেতে। উফ্‌! দম বন্ধ হয়ে আসছে। স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে “বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অনিমেষ হালদারের রহস্যজনক মৃত্যু”।

বিকাশ এসে দাঁড়ায় দরজায়। অনেকক্ষণ বেল বাজানোতেও কেউ খোলে না দরজা। হঠাৎ দূর থেকে সন্ধ্যা আর ঝুমকীকে আসতে দেখে সে। সন্ধ্যার হাতে সেদিনকার ফেরত চারশো টাকা দিয়ে চলে যায়। চিন্তিত সন্ধ্যা অনেকবার বেল বাজায়, ধাক্কাধাক্কি করে, কেউ দরজা খোলে না।

ইন্সপেক্টর সোম গম্ভীরভাবে মাথা নাড়েন- 
-না, ডঃ চক্রবর্তী, আমি ঐ কাজের লোকটিকে কিছুতেই এত সহজে ছাড়ব না।
-না, আমি নিজে চেক করেছি, ডেফিনিট হার্ট অ্যাটাক, শান্ত গলায় সহদেব বলে।

অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর সন্ধ্যা এখন একটু শান্ত। সহদেবকে ডেকে বলে-
-বাবুকে কব্বে থিকা বুলচি, আপনের শরীলডা ভ্যালা নাই। উনি কান করলেক নাই। আর এখুন কি হবে র‍্যা, আমাগো কি হবে? আবার কাঁদতে থাকে সন্ধ্যা।

ইন্সপেক্টর সোমের হাসি চোখ এড়ায়নি সহদেবের। এত কান্নাকাটি নিতান্ত অশোভন হয়ে পড়ছে দেখে সন্ধ্যাকে ওপরের ঘরে পাঠিয়ে দেয় সে। সোমের অনুমতি নিয়ে ঐ বড় বড় কাগজগুলো হাতে নেয়। সবই তার স্যারের হাতের লেখা। কোনটায় লেখা আছে “প্রতিমা পুড়ে বিষণ্ণ শারদোৎসব”, একটাতে লেখা আছে “পরিচারিকার সাথে অবৈধ প্রেম, ধৃত গৃহস্বামী”, “বাংলায় পট পরিবর্তন”, “পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু মত্ত রিক্সাচালকের” এসব অনেক কিছু। সব কটা কাগজই হলুদ দাগ ধরে গিয়েছে। ইন্সপেক্টরের বক্তব্য- মশলাপাতি রাখা বা বাটা হয় এমন কোন জায়গায় রেখে লেখা।

ফ্রিজে এখনও আধখাওয়া হুইস্কির বোতল রাখা। ডেডবডি নিয়ে যাওয়া অনেকক্ষণ হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসবে একটু পরেই। চেনা লোক বলে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলেছেন কর্তৃপক্ষ। নাহ্‌, প্রতুলকে একটা ফোন করতে হবে। কালকের কাগজে বেরোন চাই খবরটা। স্যারের ইচ্ছে এভাবেই পূর্ণ হোক। দলা করে একটা কাগজ ছুঁড়ে ফেলে সহদেব। “...রহস্যজনক মৃত্যু”- স্যারের হাতে লেখা আগের শব্দগুলো ততক্ষণে ধুয়ে গেছে বৃষ্টির জলে।

লেখকের সম্পর্কে জানতে এই পাতায় আসুন

4 comments:

  1. ভিডিও তৈরী হলে অনিমেষের ভূমিকায় মোটা। নারীসঙ্গলোলুপ মোটা-সোটা অ্যাকাডিমিশিয়ান।

    ReplyDelete
    Replies
    1. তুমি তো মোটা ছাড়া আর কাউকে চোখে দেখতেই পাও না ... :P

      Delete
  2. আচ্ছা বেশ, সন্ধ্যার রোলটা তোর। সহদেব, মানে যে প্রচুর খায়-টায়, সেটা রাজা।
    আমি ইন্সপেক্টর সোম। :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি বাপু ক্যামেরার পেছনে থাকতেই বেশি ভালোবাসি ;)

      Delete